Braking News

6/recent/ticker-posts

শিক্ষকদের আত্মোপলব্ধির সময় এসেছে



অষ্টম পে স্কেলে বহুল আলোচিত 'মর্যাদা' বিষয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন ওঠার পর গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন, তা আগে কখনও দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না। এ নিয়ে নানামুখী যুক্তি আমরা শুনে এসেছি। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার লাভ-ক্ষতি নিয়েও। আমার মনে হয়, এখনই সময় বিষয়টি নিয়ে আত্মোপলব্ধি বা আত্মবিশ্লেষণের।

অনেকেই মেনে নেবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করুক তা মোটেও কাম্য নয়। এজন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থনের ক্ষেত্রে আমার অবস্থান হলো, আদর্শিক জায়গা থেকে কোনো দলের ভালো কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন বা সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা করতেই পারেন। তার মানে এই নয় যে, কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে চোখ বুঝে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। বলতে গেলে বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাদা, নীল, হলুদ ইত্যাদি রঙে সরাসরি রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে রয়েছেন। শিক্ষকদের দেখা গেছে, দলের নেতা-নেত্রীদের আগমন উপলক্ষে ব্যানার হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে।

এই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক পথচলা, বেতন বৈষম্য দূরীকরণে অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন হলো তাদের সর্বশেষ পরিণাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি রাজনৈতিক দলের এতটা আজ্ঞাবহ বা নেতাদের পদলেহন না করতেন, তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতো_ এই ভাবনা হয়তো নিরর্থক। কারণ, আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, সব কাজের কলকাঠি হলো রাজনীতি, আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন।

পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে_ এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিসিএস পরীক্ষা দিতে হবে কি-না। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছে, রাজনৈতিক দলের প্রায় সবাই মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যোগ্যতাসম্পন্ন নন এবং তাদের অনেকেই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না। এ ধরনের উপলব্ধি সরকারের সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকেও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে।

বিগত কয়েক বছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের যোগ্যতা বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমন অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তার ক্লাসের অন্য ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে যারা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর অফিসার হয়েছেন তাদের চেয়ে কম। এমন অনেককে পাওয়া যাবে, প্রথম শ্রেণীসহ ক্লাসে প্রথম হওয়ার পর বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করছেন, ক্লাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, আর সপ্তম বা অষ্টম রাজনৈতিক সুবাতাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে, বিসিএস অফিসার হিসেবে কর্মরত অন্যরা তাদের চেয়েও নিচুমানের রেজাল্টধারী শিক্ষকদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এর জন্য দায়ী কে? আমার মতে দায়ী হলো : প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি এবং দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ। মূলত শিক্ষকরাই রাজনীতিবিদদের সুযোগ করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হবে বলে আইন থাকলেও স্বায়ত্তশাসনের নামে চলছে রাজনৈতিক স্বৈরশাসন। কিছুসংখ্যক শিক্ষকের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠার সুবাদে বহিরাগত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা অনায়াসে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলা, সব সাফল্য এখন আর শিক্ষকদের নয়; বরং রাজনীতিবিদদের দাবি, তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগও সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে। ভিসি-প্রোভিসিগণ তাদের চেয়ার শক্ত রাখার জন্য একের পর এক রাজনৈতিক মদদে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে গেছেন। এতদিনে তাদের উপলব্ধি হওয়া উচিত যে, রাজনৈতিক মদদে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের দিয়েই তাদের যোগ্যতাকে বিচার করা হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য হলো, যে রাজনীতিবিদের সুপারিশে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্নদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেই রাজনীতিবিদরা এখন শিক্ষকদের কম যোগ্যতাসম্পন্ন বলে বেতন কাঠামোর নিম্নস্তরে স্থান দেওয়াকে সমর্থন করছেন।

এমন পরিস্থিতিতে সব পক্ষেরই শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কামনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন থেকে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আর সরাসরি লেজুড়বৃত্তি বিষয়ে সজাগ হবেন। কোনো ক্রমেই তাদের উচিত হবে না যোগ্যতমদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কথামতো অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া। যদি এমনটি তারা ভবিষ্যতেও করতে থাকেন, তাহলে এর চেয়েও নিকৃষ্টতম সময় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে, রাজনীতিবিদদেরও উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আপন গতিতে চলতে দেওয়া। একটি সভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে শিক্ষকদেরই সর্বোচ্চ আসনে রাখতে হবে। এটি মোটেও নজিরবিহীন নয়।
লেখক: শিক্ষক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Post a Comment

0 Comments