
‘বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র সুপারিশ আমলে নেননি আমলারা। মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি করে অষ্টম বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যরা। মন্ত্রিসভা কমিটি প্রথম বৈঠকে বসার পর দ্বিতীয় বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবসহ কয়েকজন কর্মকর্তা (জ্যেষ্ঠ আমলা) নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করেছেন। তাদের চাতুর্যের কারণেই বেতন কাঠামো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্য, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তা।
এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী। অন্যদিকে বেতন দ্বিগুণ করা হলেও কেনো এখনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অসন্তোষ তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
এ অবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ, বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বৈষম্যের অভিযোগ উত্থাপন হলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেন।
মন্ত্রিসভার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘বেতন কাঠামোয় অসন্তোষ নিয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে আলোচনার অবতারণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নেতৃত্বে গঠিত ‘বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র সদস্য। তোফায়েল আহমেদ বলেন, বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটি গঠনের পর একটি সভা হলেও সেই সভার সিদ্ধান্তের প্রতিফলন বেতন কাঠামোর গেজেটে ছিল না। গেজেটে সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটলে এখন কেউ আন্দোলন করত না। গেজেট অন্যভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী মন্ত্রিসভার উদ্দেশে আরও বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এরপরও তাদের মধ্যে অসন্তোষ থাকবে কেন? সেটা বিবেচনায় নেয়া উচিত।’
তোফায়েল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘নতুন বেতন কাঠামোতে শুধু শিক্ষক নয়, ক্যাডার-নন ক্যাডার বৈষম্যও করা হয়েছে।’ এই সময় প্রধানমন্ত্রীও সহমত পোষণ করে বলেন, ‘সবার বেতন বাড়ল। ডাবল হলো। এরপরও তারা খুশি না হয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করবে কেন?’
এক পর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেতন কাঠামো বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন আপত্তির বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। তিনি মন্ত্রিসভায় জানান, ‘মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তগুলো গেজেটে নেই। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদাও এক গ্রেড নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। এসব সমস্যা সমাধান হওয়া প্রয়োজন।’
শিক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে আরও জানান, ‘বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশের পর অর্থ সচিব আমাকে বলেছিলেন শীঘ্রই মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক আহ্বান করবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেটাও হলো না।’
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বেতন কাঠামো সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনা চলে জানিয়ে মন্ত্রিসভার একজন সদস্য জানান, অনির্ধারিত আলোচনায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নানসহ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনার এক পর্যায়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বেতন কাঠামোর গেজেট জারির আগে ভেটিংয়ের (আইনি মতামত) জন্য আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তগুলো না থাকায় প্রথমে আমি তাতে স্বাক্ষর করতে চাইনি।’
অষ্টম পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা বেতন আগের তুলনায় কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেছে বলে অভিযোগ করে আসছেন। বৈষম্যের অভিযোগ করছেন, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক এবং বিসিএস ২৬টি ক্যাডার (প্রশাসন ও জুডিশিয়াল ক্যাডার ছাড়া) ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না থাকায় বঞ্চনার অভিযোগ করছেন সরকারি আরও কয়েকটি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংগঠন। এছাড়া নতুন কাঠামোতে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের প্রবেশ পদ অষ্টম গ্রেডে নির্ধারিত হবে। অপরদিকে নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা প্রথম শ্রেণির পদে প্রবেশে আগের মতো নবম গ্রেডে বেতন পাবেন। কিন্তু সপ্তম বেতন কাঠামোয় ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে কোন বৈষম্য ছিল না।
শিক্ষক ও ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবি পর্যালোচনায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকও করেন। গত ৬ ডিসেম্বর বৈঠকে অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের তিনটি দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও বেতন কাঠামোর গেজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনি বলে অভিযোগ ওঠে। পরে গত ১৫ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
‘বেতন ডাবল করে দেয়ার পরেও ক্ষোভ কেন’ এমন প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় বলেন, ‘যেসব কর্মকর্তা (সচিব) বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তাদের নিয়ে সোমবারই (গতকাল) বৈঠকে বসব। বেতন ডাবল করলাম এরপরেও কেন অসস্তোষ থাকবে?’
একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা সচিবের মর্যাদা চান। সচিবদের সঙ্গে কী তাদের (অধ্যাপক) তুলনা চলে। ড. আনিসুজ্জামানকে কি কোন সচিবের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পাণ্ডিত্য ও ব্যক্তিত্বই শিক্ষকদের স্টেটাস (মর্যাদা)।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা যেহেতু সচিব হতে চায় তাদের চাকরির বয়স কমিয়ে সচিবদের সমান ৫৯ বছর করে দেন। তারা কথায় কথায় সচিব সচিব করেন। তবে তারা সচিবই হোন। সচিবরা যেমন অফিস করেন, তারাও ঠিকমতো ক্লাস করান কিনাÑ তা দেখুন। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও কনসালটেন্সিও বন্ধ করুক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানায়, ‘অর্থমন্ত্রী তিনটি দাবি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো হচ্ছে অষ্টম বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সপ্তম জাতীয় বেতন কাঠামোর অনুরূপ সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখা এবং এক্ষেত্রে সপ্তম বেতন স্কেলে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা না কমানো; জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য সৃষ্টি করা সুপার গ্রেডে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের একটি অংশকে শতকরা হারে উন্নীত করার বিধান এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন সপ্তম গ্রেডে সম্ভব না হলে অষ্টম গ্রেড থেকে শুরু করা। কিন্তু প্রথম দুটি দাবির বাস্তবায়ন বেতন কাঠামোর গেজেটে উল্লেখ নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স এখন ৬৫ বছর। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর।
0 Comments