Braking News

6/recent/ticker-posts

'প্রাথমিকে ঝরে পড়া কমাতে চাই টাস্কফোর্স'


প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর 'বার্ষিক প্রাথমিক স্কুল জরিপ-২০১৫' নামে একটি জরিপ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ঝরে পড়ার হার মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। এই এক বছরে ঝরে পড়ার হার আরও কম হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

গল্পকার, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ইত্যাদি বহুবিধ পরিচয়ে গুণান্বিত এই অধ্যাপক মনে করেন, ঝরে পড়ার হার আরও দ্রুত কমানোর জন্য সরকারের একটি আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা উচিত। এছাড়া এ হার আরও কমাতে এবং স্কুলে শতভাগ শিশুকে ধরে রাখতে তিনি বেশ কিছু ভাবনা প্রকাশ করেছেন।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সরকার সাধারণত ঝরে পড়ার হার কমাতে বিভিন্ন দেশ থেকে এক্সপার্ট নিয়ে আসে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো সামনে এনে তবেই মাঠে নামা উচিত। কিন্তু এর জন্য আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে বুঝে আমাদের মতো করে বিশ্লেষণ করে এই ঝরে পড়ার হার কমানোর জন্য খুব ভালো কাজ করতে পারি।

ঝরে পড়ার হার খুব দ্রুত কমবে না এমন হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আসলে আমাদের দেশে ঝরে পড়ার হার খুব দ্রুতগতিতে কমবে না। এটা আমাদের সমাজের মানসিকতার সঙ্গে জড়িত। তবে আমি মনে করি অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রাথমিকে শিশুদের ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমছে। তারপরও গত একবছরে যে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ ঝরে পড়া শিশুর হার কমেছে তা খুব বেশি নয়, আর এটাই আসলে প্রকৃত চিত্র। এটা অন্তত ১ অথবা ২ হলে বেশি খুশি হতাম। আর এর জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বচ্ছ্লতা বাড়লেই যে সব পরিবার তাদের সন্তানকে স্কুল পাঠাবে তা কিন্তু নয়। মূল কথা হলো, লেখাপড়া যে একটা 'সোশ্যাল ক্যাপিটাল' বা 'সামাজিক পুঁজি'—এই বাণীটা আজও একেবারে গ্রামের ভেতরে পৌঁছায়নি।

শিশু শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমাতে অনেক ধরনের আইডিয়া মাথায় ঘোরে তার। এগুলো কাজে দেবে বলেও মনে করেন তিনি। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে ইচ্ছা করলে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারেন। আমি জানি তিনি ইচ্ছা করলেই পরেন। এই টাস্কফোর্সের কাজই হবে শিশুদেরকে কিভাবে স্কুলে ধরে রাখা যায়, বৃত্তি ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা, কারা দরিদ্রতার জন্য স্কুলে আসতে পারছে না তার তালিকা তৈরি করা। এই টাস্কফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা ঘুরে ঘুরে মনিটরিং করবেন, স্কুলে স্কুলে যাবেন, ঝরে পড়ার কারণ খুঁজে বের করে বিশ্লেষণ করবেন এবং টাস্কফোর্সের প্রধানের কাছে রিপোর্ট প্রদান করবেন। এই দলের সদস্য সংখ্যা ৫০ অথবা ১০০ জন হতে পারে। আর রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে সঙ্গে সঙ্গে সেই রিপোর্ট অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে টাস্কফোর্স কর্তৃপক্ষ।

প্রধানমন্ত্রী এই টাস্কফোর্সের প্রধান হতে পারেন অথবা তিনি যাকে বিশেষ বিবেচনা করে দায়িত্ব দেবেন তিনিই হবেন এর প্রধান। আমাদের মুখ চেনা মানুষকে এই টাস্কফোর্সের প্রধান করলে চলবে না। যাদের এই বিষয়ে ডেডিকেশন রয়েছে তাদেরকে এই দলে আনতে হবে। অর্থাৎ যাকে এই টাস্কফোর্সের প্রধান করবেন তার আর কোনও কাজ থাকতে পারবে না। যেমন, কোনও মন্ত্রী হলে চলবে না, কারও কোনও রুটিন কাজের সঙ্গে মিলিয়ে এটা করা যাবে না।

তিনি বলেন, অন্যান্য শিক্ষাবিদ বা যাদের শিক্ষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা রয়েছে তাদেরকে এই টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা যদি করা হয় তাহলে বেশ ভালো কাজ করতে পারবেন তারা। আর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আন্ডারে টাস্ককোর্সটি থাকতে পারে।

টাস্কফোর্স টিমে মেধাবী শিক্ষিত তরুণদেরকে মাঠ পর্যায়ে গবেষণার জন্য রাখা যেতে পারে বলেও মত প্রকাশ করেন ড. মনজুরুল। তিনি বলেন, 'মেধাবী তরুণদেরকে এই টিমে আনতে হবে। যেমন, যাদেরকে দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শিশুদেরকে একসঙ্গে নিয়ে পড়ায়। আমি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি, দেখেছি শিশুদেরকে স্কুলে ধরে রাখতে এসব তরুণদের মাথায় দুর্দান্ত আইডিয়া রয়েছে।'

এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই দরকার বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, আমাদের দেশের শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল থেকে বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের ঝরে যাওয়ার একটি মূল কারণ হচ্ছে, নিরাপত্তার সমস্যা। মেয়েদের ঝরে পড়া কমাতে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে। আর এই সামাজিক নিরাপত্তা আসলে পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে নিশ্চিত করা যাবে না। এর জন্য পরিবার, গ্রামের সমাজের যে সব ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি যেমন, মসজিদের ইমামদের কাজে লাগাতে হবে। এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা যদি গ্রামে থাকেন অর্থাৎ সমাজের সব ধরনের মানুষকে নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে বৈঠকে বসতে হবে।

আমাদের সন্তানরা স্কুলে যায় তাদের সঙ্গে যাতে কেউ যাতে বখাটেপনা করতে না পারে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। কেউ যদি এমন করে তাহলে তাকে ধরে সরাসরি পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। এই যদি হয় আমাদের সমাজের সিদ্ধান্ত তাহলে কোনও ছেলে আর বখাটেপনা করতে যাবে না। আর এর জন্য দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এমনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেন বখাটেপনা, যৌন হয়রানি শব্দই মানুষ ভুলে যায়। এর আরও একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারে ওই বখাটের পরিবারকে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করতে হবে যাতে তাদের পরিবার নিজেদের সন্তানকে ঠিকমতো শাসন করেন। এটা কিন্তু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন নিয়ে তিনি বলেন, 'শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না, এটাও আমাদের দেশে বড় সমস্যা। তবে এর পেছনে কারণও আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানের মানটা অনেক কমে গেছে। শিক্ষায় যদি বিনিয়োগ না বাড়ে অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশা হিসেবে যদি আকর্ষণীয় না হয় তাহলে তো মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চাইবে না। আর মেধাবীরা না আসলে মুখস্তবিদ্যার চর্চা হবে, শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়ে শিক্ষা নিতে হবে পরীক্ষায় মুখস্ত বা নকল করে পাশ করার প্রবণতা বাড়বে। তাতে আসলে কোনও লাভ হবে না। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাড়বে কিন্তু তারা না পারবে বাস্তবের সঙ্গে তাল মেলাতে, না পাবে ভালো চাকরি। ফলে তারা তো সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আর শিক্ষার মান ভালো করা, স্কুলে শিক্ষার্থীদেরকে ধরে রাখার অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে এই খাতে মূলত সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়ালে কোনও ভাবেই এর সমাধান হবে না। কিন্তু আমি জানি সরকার কখনও এখানে বিনিয়োগ বাড়াবে না। আর বিনিয়োগ না বাড়ালে একই গতিতে চলবে। আমরা দাবি করছি, বাজেটের ২৫ ভাগ এই খাতে দিতে হবে। এটা প্রথমে ১৫ ভাবে উঠেছিল এখন আরও কমে মাত্র ১১ ভাগে নেমে এসেছে। ফলে ২০ ভাগে উন্নীত করা খুবই জরুরি। আর ২০ ভাগে উন্নীত করাটা আমাদের সরকারের জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। আর তাতেও কিন্তু অনেক সুযোগ সুবিধা হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকতা পেশাকে সম্মান দিতে হবে।'

শিশুদের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে বাচ্চাদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা গেলে অনেক বেশি ভালো হতো, যেখানে বাচ্চা ও তার অভিভাবক ছাড়া আর কেউ উঠতে পারবে না। এরকম বাস যদি পুরো ঢাকা শহরে আন্তত ৫০ টার মতো ঘোরে তাহলে বাচ্চাদের যাতায়াত সমস্যা অনেকটা দূর হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে কিছু বাস দেখেছিলাম এমন বাস কিন্তু এখন আর দেখি না। কারণ এর তো কোনও তদারকি করে না সরকার।

গ্রামের শিশুদের স্কুলে যাতায়াত সুবিধা খুব বেশি করে খেয়াল করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, হাওড় অঞ্চলে শিশুদের স্কুল যাওয়া আসা করা খুবই বড় ধরনের সমস্যা। বর্ষার সময়ে বাচ্চাদেরকে তাদের পরিবার স্কুলে যেতে দেয় না। ঝড় তুফানের কোনও আলামত দেখলেই তারা ঘরে বসে থাকে। ফলে দিনের পর দিন তারা স্কুল থেকে বিরত থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভালো রাস্তাঘাট তৈরি করতে হবে। মূলত এটা কিন্তু শুধু শিক্ষার জন্য না। এটা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যেও দরকার। এছাড়া বাড়ি থেকে খুব কাছে স্কুল থাকলে বাচ্চারা স্কুলে যায়।

আর সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দারিদ্রতা। এট বলার অপেক্ষা রাখে না যে দারিদ্রতার কারণে শিশুরা ঝরে পড়ে। দারিদ্রতার কারণে বেশিরভাগ পরিবার তাদের সন্তানকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়। আর ছাড়িয়ে নেওয়ার কারণ তাদেরকে মাঠে কাজ করতে পাঠায়। মাঠে কাজ করে তো সে টাকা পাচ্ছে। তাই তারা পরিবার চায়, সে মাঠে কাজ করুক। কিন্তু এই দারিদ্রতা থেকে তো আমরা এইসব পরিবারকে একদিনে মুক্ত করতে পারবো না। তবে যদি স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি দেওয়া যায়। যারা দুস্থ পরিবার থেকে স্কুলে আসে সেই পরিবারের উপার্জন অনুযায়ী শিশুদেরকে মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দেওয়া যেতে পারে। মাস শেষে যখন পরিবারের হাতে শিশুরা বাড়িতে ফিরে টাকা দিতে পারবে তখন তো তাদের পরিবারই খুশি হবে এবং পরিবারের বাবাই তার বাচ্চাকে স্কুল পৌঁছে দিয়ে আসবে। এর আরও বড় কারণ হলো প্রতিটি বাবাই তো চাই তার সন্তান উন্নতি করুক, শিক্ষিত হোক।

শিশুদেরকে স্কুলে মান সম্মত দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মতামত দেন তিনি। পাঠ্যপুস্তক দেওয়ার পাশপাশি অন্যান্য উপকরণ দেওয়া যেতে পারে শিশুদের। পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে কলম, মুছনি, স্কেল বক্স, জ্যামিতি বক্সসহ একটি সুন্দর একটি ব্যাগ দেওয়া গেলে খুব ভালো হয়। এতে শিশুরা তো খুব খুশি হয়ই সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবারগুলোর কিন্তু অনেক বেশি সহায়তা হয়।

আরও একটি বিষয় হলো স্কুলে শিক্ষার্থীদের ফি বাড়ানো যাবে না। ইদানিং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে যে বেতন ফি বাড়ানো হয়েছে তা আসলেই ঠিক নয়। স্কুলে ফি বাড়ানো যাবে না। প্রাইভেট পাবলিক সব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই তো সমাধান হয়ে যায়।

সর্বশেষ তিনি বলেন, শ্রেণিকক্ষকে অবশ্যই শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় করতে হবে। আর শিশুদের কোনও ভাবেই নির্যাতন করা যাবে না। তাদেরকে আদর করে বোঝাতে হবে।- খবর বাংলা ট্রিবিউন'র।

Post a Comment

0 Comments