
বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা এমপিও'র মাধ্যমে তাঁদের 'বেতন ভাতার সরকারি অংশ' পেয়ে থাকেন। আগে প্রতি তিন মাস পর পর এমপিও আসতো। এখন দু'মাস পর পর আসে। এমপিও কখন দেয়া হচ্ছে, কখন আসছে, কোনো পরিবর্তন আছে কী-না ইত্যাদি অনেক বিষয়ে শিক্ষক কর্মচারীদের জানার আগ্রহ থেকেই তাঁরা নানা মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। তার ওপর 'ব্যাংক-দুর্গতি' তো আছেই।
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ইদানিং প্রায়ই বলে থাকেন, এমপিও একটি বাজে সিস্টেম। তিনি একবার এও বলেছেন যে, আমাদের দেশ থেকে এমপিও'র ধারণাই উঠিয়ে দেয়া উচিত। মাননীয় মন্ত্রীর এসব বক্তব্যের জের ধরেই আজকের এ লেখার সূত্রপাত।
মন্ত্রী মহোদয় কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নিজস্ব মতামত দিয়েছেন, সেটা বলা কঠিন হলেও একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে তিনি চাইলে এমপিও'র ভোগান্তি থেকে দেশের পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে রেহাই দিয়ে তাঁদের চাকরি সরকারিকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতির ইতিহাসে চির স্মরণীয় একটি আসনে উন্নীত হতে পারেন। এমন একটি প্রত্যাশা করা অসমীচিন হবে না। তাঁর বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে অন্তত এরূপ ঈঙ্গিতই পাওয়া যেতে পারে। তা হলে এমপিও যে একটি 'বাজে সিস্টেম' তার যথার্থতা যেমন প্রমাণিত হবে, তেমনি এ দেশ থেকে এমপিও'র ধারণাটাও মুছে যাবে।
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের উপর এরূপ আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির কারণ হিসেবে একটি উদাহরণ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা আবশ্যক মনে করছি। গত শতকের শেষ দশকে সম্ভবত '৯৩ কিংবা '৯৪ সালে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের স্কেলের শতভাগ বেতন ভাতা পাবার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সিলেট জেলা শিক্ষক সমিতির ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হয়ে আসেন তৎকালীন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তিনি শিক্ষক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শ্রবণ করেন।
মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী একদা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, বিশ্ব বরেণ্য কুটনীতিক হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সভাপতিত্ব করেছেন এবং সর্বোপরি '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার সময় জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত থাকার কারণে শত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবেন্ধুর দু'কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে তাঁদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।
'৯১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী মহান জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন।
জেলা শিক্ষক সমিতির সম্মেলনে নেতৃবৃন্দের সুখ-দুঃখ মাখা বক্তব্য শুনে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁদের আশ্বস্থ করলেন এভাবে, "আপনাদের দাবি দাওয়া পূরণের বিষয়ে একজন স্পিকার হিসেবে আমার তেমন কোন এখতিয়ার নেই। তবে, সরকারের উপর আমার কিছু প্রভাব আছে। সে প্রভাবটুকু খাটিয়ে দেখা যাক আপনাদের জন্য কী করতে পারি?"
বিকেলের ফ্লাইটেই তিনি ঢাকা চলে যান। পরদিন রেডিও, টেলিভিশন সহ সকল সংবাদ মাধ্যমে জানা গেল যে, সরকার বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের নিজ নিজ স্কেলের শতভাগ বেতন প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সেদিন থেকে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দেশের সকল স্তরের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভালবাসায় সিক্ত হলেন এবং অনন্তকাল ধরে তাঁদের হৃদয়ের মনিকোঠায় বেঁচে থাকবেন।
এবার এমপিও ভোগান্তি বিষয়ে একটু আলোকপাত করা আবশ্যক। মাননীয় মন্ত্রী এ সব ভোগান্তি বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের লক্ষ্যে এমপিও উঠিয়ে দেবার চিন্তা করে থাকলে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নিলে দেশের কয়েক লক্ষ শিক্ষক কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার পরিজন চিরদিন কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকবেন।
এমপিওভুক্ত হওয়া এক মহা মুশকিল। দিনে দিনে প্রক্রিয়াটি আরো জটিলতর হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়া এবং শিক্ষক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
কতিপয় শর্ত পূরণ সাপেক্ষে যে কোন প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবোর্ড থেকে প্রথমে পাঠ দানের অনুমতি এবং তারপর শর্ত পূরণ বিবেচনায় স্বীকৃতি লাভ করে থাকে। স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর কাল বিলম্ব না করে এমপিওভুক্ত করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু কই, আমাদের দেশে শত শত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা স্বীকৃতি লাভের দশ-কুড়ি বছর পর আজও এমপিওভুক্ত হতে পারে নাই। আবার, এমনও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা শর্ত পূরণ ছাড়াই রাতারাতি এমপিওভুক্ত হয়েছে। টাকার জোর, মামুর জোর কিংবা অন্য যে কোন প্রভাব খাটিয়ে তা করা হয়েছে। অবশ্য এ সংখ্যাটি খুব বেশি নহে।
যে সব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয় নাই, সে সব প্রতিষ্ঠান ও তাদের শিক্ষক- কর্মচারীদের দুর্ভোগের খবর আল্লাহ ছাড়া কে জানে? গত বিশ বছরে দেশে ক'টা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে? কিন্তু, প্রয়োজনের তাগিদে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তো দেশে গড়ে তুলতে হয়েছে কিংবা গড়ে উঠেছে।
শিক্ষক কর্মচারী এমপিওভুক্ত হওয়া তো আরেক মহা ঝামেলা। শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের নতুন নিয়মে কী হবে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু স্থগিতকৃত নিয়মে নিয়োগ থেকে শুরু করে এমপিওভুক্তি পর্যন্ত সাত ঘাটের জল খেতে খেতে আর ঘাটে ঘাটে ধর্ণা দিতে দিতে এক সময় এমপিও নামক সোনার হরিণের দেখা মিলতো।
তাতে নিয়োগ কমিটি গঠনের জন্য মহা-পরিচালক মহোদয়ের প্রতিনিধি মনোনয়ন পত্রটি জেলা শিক্ষা অফিস থেকে নিয়ে আসতে কতো বিচিত্র কাগজ পত্রের এক বিরাট ফাইল প্রস্তুত করে পাঠাতে হতো। বছরে যতোবার নিয়োগ, ততবারই এ ঝামেলা পোহাতে হতো। আরো কত কী ঝামেলা, ভুক্তভোগী ছাড়া ক'জনে জানে?
এমপিও পাবার জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতে হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীদের। যা একদিন এলো, কিন্তু ব্যাংক ওয়ালাদের গড়িমসি দেখে বিরক্তির মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তাঁরাও কী বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়তি ঝামেলা মনে করে? ননসেন্স!
দেশ ও জাতি গঠনে যাঁদের অবদান ৯৫ শতাংশ, তাঁদের এমপিও ভোগান্তি দূর করার লক্ষ্যে চাকরি জাতীয়করণ করা ছাড়া ভিন্ন কোন চিন্তা করা উচিত নয়। যাঁরা এমপিওভুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন, তাঁদের কথাও মাথায় রেখে যা করার তা-ই দ্রুত করা উচিত। কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মাননীয় মন্ত্রীর ভাবনা যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে তা দেশ ও জাতির জন্য দূর্ভাগ্যজনক।
এ দু'মন্ত্রণালয়ের মাননীয় দু'জন মন্ত্রী একই এলাকার মানুষ। ভবিষ্যতে এরূপ কোনদিন হবে কী-না কে জানে? সরকারের উপর দু'জনেরই প্রভাব এবং এতদবিষয়ে দু'জনেরই অনেক কিছু করার এখতিয়ার রয়েছে। প্রয়োজন কেবল সময় করে দু'জনের এক টেবিলে বসার।
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ, আপনাদের দু'জনের দিকে দেশের পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ দেশবাসী অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। তাঁরা আপনাদের দু'জনের মাঝে মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে খুঁজে পেতে চান।
0 Comments