
বর্তমান সরকারের বিনা মূল্যে বই বিতরণের সাফল্য সারা বিশ্বে বিরল। এ কর্মকাণ্ড বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। এর মহান উদ্দেশ্য ম্লান করে দিয়েছে শিশুদের জন্য কঠিন কঠিন ইংরেজি, বাংলা বইসহ নোট-গাইডের ব্যাপকতা। প্রাথমিকে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকের কাছে নোট-গাইডের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বারবার লেখালেখির পরও কেউ কানে তুলছে না। ব্যাপারটা এখন কামারের দোকানে কোরআন পড়ার মতো। অপরদিকে সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) কিছু কর্মকর্তার অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে। সবকিছুই যেন ম্যানেজ করে চলছে। এ চলা আর কতদিন আগামী প্রজন্মকে উল্টো পথে ঠেলে দেবে এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের কাছে।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধান হল প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের প্রধান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা পূরণ করেনি সরকার। পুরোটাই ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রধান শিক্ষকদের ৮ হাজার টাকা স্কেলের ২য় শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া ও সহকারী শিক্ষকদের পরবর্তী নিচের স্কেল দেয়ার প্রস্তাবও প্রেরণ করা হয়। অথচ ট্রাফিক জটে এ আদেশ রুট পরিবর্তন হয়ে প্রধান শিক্ষকদের ৬ হাজার ৪০০ টাকা স্কেলে ২য় শ্রেণীর মর্যাদা ও সহকারী শিক্ষকদের ২টি স্কেল নিচে বেতন দেয়ার আদেশ জারি হয়। এ আদেশ অর্থ, সংস্থাপন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষরে জারি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের ভাষণে ৯-৩-২০১৪ এ ঘোষণা দেন। ঘোষণার ২ বছর পরও ট্রাফিক জটে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক প্রধান শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলে সিনিয়রদের পিপি দেখিয়ে ঘোষণার দীর্ঘ দেড় বছর পর বেতন নির্ধারণ করা হয়। অনেকের দীর্ঘ সময় বেতন না বেড়ে একই জায়গায় আটকা পড়ে। সাধারণত ট্রাফিক জট কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়; কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের যে কোনো ধরনের প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে এক বিশাল জটের পথ পাড়ি দিতে হয়। বকেয়া বেতন প্রাপ্তির অনুমোদন টাইম স্কেল, পেনশনপ্রাপ্তি, এক কথায় সমুদয় প্রাপ্তি বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। এ জট সরাতে বিপুল অর্থও খরচ করতে হয়।
এক আদেশবলে প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা আপাতত স্থগিত করা হয়, এ যেন দুঃসহ ট্রাফিক জট। খোদ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রাথমিক শিক্ষকরা খানিকটা স্বস্তি পান। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ভূলুণ্ঠিত করার সাহস কারা করল, কেন করল ব্যাপারটি বোধগম্য নয়। অপরদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর করার প্রস্তাব অদৃশ্য করে দেয় কোন মহল? কী এমন শক্তি ও সাহস তাদের! ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় বা সংকেতে কিছু সময়ের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রের এ বিড়ম্বনা যেন শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের ভাবনা নেই বললেই চলে। বেতন স্কেল চূড়ান্ত বাস্তবায়নের আগে সহকারী শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে অর্থমন্ত্রী ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে অনেক আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে জানালেন, এর আগে শিক্ষকদের এ বৈষম্য আমাকে অন্য কেউ জানায়নি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে বৈষম্য দূর করা হবে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থের ভাণ্ডার যার হাতে তার কাছ থেকে এ আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল। তার পরের গল্প সবার জানা। আশাহত শিক্ষকরা আকাশ থেকে পড়লেন। আজকের দিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী প্রদত্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূর করার আশ্বাস ও অর্থমন্ত্রীর মিডিয়ার সামনে বক্তব্য- সবই কি রাজনৈতিক বক্তব্য? দেশের সাধারণ মানুষ জ্ঞাত হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকরা সেকেন্ড ক্লাস-প্রাপ্ত হয়েছেন। তাহলে তো শিক্ষকরা গেজেটেড।
মন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসে বেতনবৈষম্য শিগগির দূর হতে বাধ্য। বছরের পর বছর এ ধরনের জ্যামে আটকে টায়ার ফেটে প্রাথমিক শিক্ষকদের স্বপ্ন খান খান হয়ে যায়। শিক্ষকদের সামান্য পাওনা নিয়ে লুকোচুরি অনেকটা ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের অবস্থা অনেকটা ওপর দিয়ে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট প্রবাদের মতো। শিক্ষকরা তাদের সামান্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার। একটি ঘৃণ্য চক্র হেয় প্রতিপন্ন করছে মাননীয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভুয়া সনদের মাধ্যমে যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা বহাল তবিয়তে পেনশন সুবিধা নিয়েছেন, তারা দেশের শত্রু। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের চেয়েও জঘন্য। তারা প্রাথমিক শিক্ষা ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে থেকে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। তাদের রেখে যাওয়া অনুচররা আজ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। প্রাথমিক শিক্ষকসহ এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী জনগণ সেসব ঘৃণ্য ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করছে। ফ্লাইওভার, উড়াল সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু, চার লেন রাস্তা ও নানা ধরনের অবৈধ দখল উচ্ছেদের মাধ্যমে যানজট দূর করার পদক্ষেপে এ দেশের মানুষ উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন দেখছে; কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষায় জট লাগিয়ে ও শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনার কথা ঘোষণা দিয়ে বঞ্চিত করা একেবারে অনুচিত। শিক্ষকদের বোকা বা নিরীহ ভাবা ঠিক নয়। অধিকার বঞ্চিত হলে এ দেশের সাধারণ মানুষ বলে থাকে, পাওনা একালে না দিলে পরকালে দিতে হবে। তখন দেয়ার সুযোগ পাবে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সরকারের কাছে নিবেদন শিক্ষা ক্ষেত্রে এ জট নিরসন করুন। নচেৎ জটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি। শিক্ষাবান্ধব হিসেবে খ্যাত এ সরকার জটের কবলে পড়ে হাবুডুবু খেয়ে মারা যাবে।
0 Comments