
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী
আমাদের সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের আর কী-ই বা অবশিষ্ট রইলো? ছোটরা বড়দের মান্যগণ্য করে না, বড়রাও ছোটদের তেমন একটা আদর করে না। স্কুল-কলেজে ছাত্ররা আজকাল বেশ পড়াশুনা করে না। পড়াশুনা যেন তাদের আবশ্যিক বিষয় নয়। মোবাইল, ফেসবুক, হোয়াটস আপ, ইমো, ভাইবার ইত্যাদি তাদের আবশ্যিক সাবজেক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকদের তারা তেমন একটা তোয়াজ-তমিজ করে না আজকাল।
সর্বত্রই অনিয়ম আর দুর্নীতি। টাকা ছাড়া কোনো অফিসের একটা ফাইল পর্যন্ত নড়ে না। কোনো অশিক্ষিত লোক তো আর অফিস চালায় না। অফিস চালায় শিক্ষিত মানুষেরা।
ন্যায়-নীতি আজ সমাজ থেকে নির্বাসিত। সমাজে ন্যায়ের চর্চা অনেকটা কমে গেছে। আমরা কী তাহলে 'জোর যার, মুলুক তার'- এর যুগে ফিরে যাচ্ছি? সমাজে সবলেরা দুর্বলদের নানাভাবে বঞ্চিত করে। যোগ্যরা হেরে যায় অযোগ্যদের কাছে।
সমাজের সর্বত্র অশুভ পাঁয়তারা। এক শ্রেণির মানুষ দিনে দিনে কেবল ধনী আর আরেক শ্রেণি কেবলি গরীব হচ্ছে।
আমাদের শিক্ষায় চরম দৈন্যদশা। শিক্ষা নিয়ে চলছে ব্যবসা। শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে বটে, কিন্তু দশগুণ দামে নোট-গাইড কিনতে হয় অভিভাবকদের। নোট-গাইডে বাজার সয়লাব। পরীক্ষায় নানা অব্যবস্থাজনিত কারণে লেখাপড়ার মান নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠেছে। এ সব রুখবে কে? কার দায়িত্ব এ সব দূর করার? সমাজ গঠনের দায় কার? জাতি গঠনের কারিগর কারা?
শিক্ষক জাতি গঠনের মূল কারিগর। জাতি তথা সমাজ গঠনে শিক্ষকের সমকক্ষ আর কেউ নয়। তাই সমাজের অধোগতির দায়ভার শিক্ষক কোনমতে এড়িয়ে যেতে পারেন না। একজন শিক্ষকের আত্মোপলব্ধির সময় এখন। শিক্ষক নিজের দায় ও করণীয় নির্ধারণে গড়িমসি করলে সমাজ ও রাষ্ট্র দিনে দিনে রসাতলে যেতেই থাকবে।
একজন শিক্ষকের অনেক কিছু জানা থাকতে হয়। নিত্যদিন অনেক কিছু জানার ও জানাবার আগ্রহ শিক্ষকের থাকা দরকার। তা না হলে শিক্ষকের জ্ঞান-ভাণ্ডার দিনে দিনে শুন্যই হতে থাকবে। শিক্ষককে নিঃসন্দেহে অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। নিত্য নতুন জ্ঞানের আধার হবেন তিনি। প্রখর মেধা ও অদম্য কর্মস্পৃহা সদা তাকে উজ্জীবিত রাখবে। নিজস্ব আদর্শকে আঁকড়ে ধরে সামনের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাবেন তিনি। নিজের শিক্ষার্থীকে আপন সন্তানের ভালবাসায় সযত্নে গড়ে তুলবেন। তিনি নিজেকে নিঃস্বার্থ ভাবে বিলিয়ে দিয়ে এক অনাবিল আনন্দ উপভোগ করবেন। পাবার জন্য নয়, কেবলি দেবার জন্য সর্বদা উন্মুখ থাকবেন। কর্মনিষ্ঠ, সময়ানুবর্তি, অধ্যবসায়ী, অধ্যয়নমুখী, প্রাণবন্ত, সৎ ও নিষ্ঠাবান থেকে জাতিকে মকসুদে মনজিলে নিয়ে যেতে যা যা করার প্রয়োজন, একজন শিক্ষক তা-ই করবেন।
কিন্তু, আমাদের সরকার তথা রাষ্ট্রের চিন্তা-ভাবনা কতটুকু শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব- তাই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের পবিত্র সংবিধানে শিক্ষা বিষয়ে রাষ্ট্রের যে দায়, রাষ্ট্র বা সরকার কী সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে? আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেবার কথা, প্রকৃতপক্ষে এ খাতে কী সে বরাদ্দ দেয়া হয়?
তাহলে আমাদের শিক্ষার এ চরম দুর্দশা কেন? আজ মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহ বোধ করে না। ক্যাডার সার্ভিস, মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং সবার পছন্দ। হবে না কেন? এ সব পেশায় কাড়ি কাড়ি টাকা। আমরা যতই নীতিবাক্য আওড়াই না কেনো, আজকাল প্রায় সারা পৃথিবীটাই টাকার পেছনে ঘুরছে। টাকা পয়সার মানদণ্ডে নির্ধারিত হয় মানুষের মর্যাদা। যার বিত্ত বৈভব যত বেশী, সেই বেশী ক্ষমতাধর।
আদর্শের যুগ এখন আর নেই। এক সময় আদর্শ ও নীতিবান লোকেরাই সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। 'ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই প্রকৃত মানুষ'- এসব কথা আজকাল আর কেউ মানে না। সে যুগ আজ বাসি হয়েছে। জ্ঞানী নয়, বিত্তশালীদের দাপটে আজ সমাজ ও রাষ্ট্র চলে।
শিক্ষকদের কতোভাবে আজ শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষক সোহাগ করে শিক্ষার্থীকে একটু শাসন করবেন- সে অধিকারটুকুও শিক্ষকদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ভালো কথা। এ জন্য শিক্ষককে শাস্তির বিধান রেখে আইন করার কী-ই বা এতো প্রয়োজন ছিলো? সে আইনের অপব্যবহার করে কতো শিক্ষক যে আজ পর্যন্ত হয়রারির শিকার হয়েছেন, তার হিসাব কে রাখে?
মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার পথ রুদ্ধ আজ এ সব কারণেই। অন্য অনেক পেশায় মেধা তেমন না থাকলেও চলে, কিন্তু শিক্ষকতায় মেধার যে কতো প্রয়োজন, তা জাতি এখন হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছে। মেধাবী প্রজন্মকে শিক্ষকতায় টেনে আনতে না পারলে এ জাতি খুব বেশী দিন বাঁচবে না।
পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করে কী হবে? সৃজনশীল মেধা সম্পন্ন শিক্ষক না থাকলে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি কেবল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চারই করবে, যা আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই প্রতিভাত হয়েছে। আমাদের এখন সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ে তুলতে সৃজনশীল ও প্রতিভাধর শিক্ষকের প্রয়োজন। রাষ্ট্র কিংবা সরকার যত সকাল তা উপলব্ধি করবে, দেশ ও জাতির ততই মঙ্গল হবে।
0 Comments